শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৮ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মানুষের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও দায়িত্ব

মো. আবদুর রহমান:
আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। বিশ^ চরাচরে সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদাবান হচ্ছে মানুষ। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে মানবজাতির পরিচয় এভাবে তুলে ধরেছেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১০) তবে মানুষ মানবীয় গুণাবলিতে গুণান্বিত হলেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিতে পরিণত হবে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

মানুষকে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার খলিফা বা প্রতিনিধি করে। মানুষ ছাড়া আর কোনো সৃষ্টিকে এমন সম্মানে ভূষিত করা হয়নি। মানুষের এ মর্যাদার কথা উল্লেখ করে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি তোমাদের পৃথিবীতে খলিফা বানিয়েছেন।’

(সুরা আনআম: ১৬৫)

আল্লাহতায়ালা খলিফা সৃষ্টি করার ঘোষণা দেওয়ার পর হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। এর অর্থ এটা নয় যে, কেবল তিনিই আল্লাহতায়ালার খলিফা। বরং আদম (আ.) এবং তার বংশধর সব মানুষের জন্য এ সম্মান। যেমন ফেরেশতারা বলেছেন, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে অশান্তি ঘটাবে এবং রক্তপাত করবে? অথচ আমরাই তো প্রতিনিয়ত আপনার প্রশংসায় তসবিহ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি।’ তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।’ (সুরা বাকারা: ৩০)। মানুষকে দিলেন সর্বোচ্চ সম্মান, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন ফেরেশতাদের মাধ্যমে আদম (আ.)-কে সেজদা করানোর দ্বারা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সেজদা করো। তখন তারা সবাই সেজদা করল, ইবলিশ ছাড়া। সে অস্বীকার করল এবং অহংকার করল। আর সে হলো কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা বাকারা: ৩৪)

আল্লাহতায়ালা মানুষকে উৎকৃষ্ট গঠন কাঠামোতে সৃষ্টি করে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। মানুষের অনুপম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্য যেকোনো প্রাণীর তুলনায় ভিন্নতর ও সৌন্দর্যমন্ডিত। চোখ, মুখ, ঠোঁট, হাত ও পা মিলে একজন সম্পন্ন সুস্থ মানুষ যেন রবের করুণা-কৃপারই মূর্তপ্রতীক। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তো মানুষকে সুন্দরতম গঠনে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা তিন: ৪)

আল্লাহতায়ালার এ ঘোষণার উদ্দেশ্য এই যে, মানুষের মজ্জা ও স্বভাবকেও অন্যান্য সৃষ্টিজীবের তুলনায় উত্তম করা হয়েছে এবং তার দৈহিক অবয়ব ও আকার-আকৃতিকেও দুনিয়ার সব প্রাণীর চেয়ে সুন্দরতম করা হয়েছে। (মারেফুল কোরআন ৮/৮১২)। আল্লামা ইবনুল আরাবি (রহ.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালার কোনো সৃষ্টিই মানুষের চেয়ে সুন্দর নয়।’ আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তিনিই তো ওই সত্তা যিনি তোমাদের মাতৃগর্ভে নিজের ইচ্ছামতো আকৃতি গঠন করেন। তিনি ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা আলে ইমরান: ৬)

অবশ্য মানুষের এ দৈহিক সৌন্দর্যগত শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে সে আল্লাহতায়ালার হুকুম মেনে চলে কি না, তার ওপর। যদি মেনে চলে, তাহলে তার শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুন্ন থাকে। সে হয় পূত-পবিত্র। আর যদি মেনে না চলে তাহলে সে নিকৃষ্টতম হিসেবে গণ্য হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতঃপর আমি তাকে (তার কর্মদোষের কারণে) নিম্ন থেকে নিম্নতম স্তরে ফিরিয়ে দিই। কিন্তু তাদের নয়, যারা ইমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে।’ (সুরা তিন: ৫-৬)

মানুষের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য আল্লাহতায়ালা মানুষের ওপর বড় ইহসান করেছেন যুগে যুগে, তাদের মধ্যে নবী ও রাসুল প্রেরণ করে। ফেরেশতা কিংবা জিন আর কোনো জাতি এভাবে সরাসরি আল্লাহর বাণী বহনের, রিসালাত বয়ানের জন্য মনোনীত হয়নি। মানুষকে আল্লাহ স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের ওপর সরাসরি নিজের কালাম নাজিল করে। অক্ষরে অক্ষরে আল্লাহ যা বলেছেন, হুবহু সেই শব্দ, বাক্য, বাণী, কোরআন, আসমানি কিতাব আর সহিফাহসমূহের (নবী-রাসুলদের ওপর অবতীর্ণ কিতাব) সব মানুষের ওপরই অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তিনি আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাজিল করেছেন, যে কিতাব তার পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যায়ন করে। আর তিনি পূর্বে মানবজাতির হেদায়েতের জন্য তাওরাত ও ইনজিল নাজিল করেছেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ৩-৪)

আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর সবকিছু মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সমগ্র সৃষ্টি তার অধীন ও অনুগত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তিনি আসমান ও জমিনের সবকিছু নিজ অনুগ্রহে তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নির্দেশনাবলি রয়েছে।’ (সুরা জাসিয়াহ: ১৩)

মানুষকে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর অন্যান্য সব সৃষ্টির ওপর আধিপত্য দিয়েছেন। মূলত মানুষকে আল্লাহ যে মর্যাদা দিয়েছেন, তা অতুলনীয়। মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, তাদের স্থলে ও সমুদ্রে চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদের পবিত্র বস্তু থেকে রিজিক দিয়েছি এবং আমার অনেক সৃষ্টির ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৭০)

মানুষকে আল্লাহতায়ালা পবিত্র রিজিক দিয়ে সম্মানিত করেছেন। মানুষ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীর জন্য এমনভাবে সুনির্দিষ্ট করে পবিত্র জীবিকা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। অন্য কোনো প্রাণীর জন্য এ জাতীয় ব্যবস্থাপনা আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। সবার চেয়ে মানুষকে মর্যাদাবান ও শ্রেষ্ঠ প্রমাণের জন্য কেবল মানুষের ক্ষেত্রেই এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ কারণে মানুষই একমাত্র প্রাণী, খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনের ওপর আল্লাহতায়ালা যাদের পুরোপুরি অধিকার দান করেছেন।

মানুষের মর্যাদার আরেকটি দিক হচ্ছে তাদের দৈহিক গঠন কাঠামো। মহান আল্লাহ এর মধ্যেও মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার উপাদান রেখেছেন। তাদের দৈহিক গঠন এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, তাকে মাথানত করে হাঁটতে হয় না। সবসময় সে মাথা উঁচু করে হাঁটে। মহান আল্লাহ ছাড়া আর কারও সামনে মানুষ মাথানত করে না। মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অন্য সব সৃষ্টি মাথা নিচু করে হাঁটে।

জগতের সব মাখলুকই প্রয়োজন অনুপাতে সম্পদ ব্যবহার করে। কিন্তু সম্পদের মালিকানা শুধুই মানুষের। সৃষ্টিকর্তা হিসেবে এ পৃথিবীর প্রকৃত মালিক তো শুধুই আল্লাহতায়ালা। অতঃপর তিনিই মানবজাতিকে এ পার্থিব সম্পদে মালিকানাদানে সম্মানিত করেছেন।

জগতের সবকিছুই যে আল্লাহতায়ালার মালিকানাধীন সে কথা তিনি পবিত্র কোরআনে পরিষ্কার করে বলেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর।’ (সুর আলে ইমরান: ১০৯)। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে আরও বলেন, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সর্বময় কর্র্তৃত্ব তারই; তিনিই জীবনদান করেন এবং তিনিই মৃত্যুদান করেন। তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ (সুরা হাদিদ: ২)

উপরোল্লিখিত আয়াতগুলো দ্বারা স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে, আল্লাহতায়ালা যেমন এই জগতের সমুদয় সৃষ্টির মালিক, তেমনি তার প্রিয় সৃষ্টি মানুষও তার একান্ত দয়া ও অনুগ্রহে সম্পদের মালিকানায় গৌরবান্বিত। এটি মানুষের মর্যাদা। আল্লাহতায়ালা একমাত্র মানুষকে বিবেক, বোধশক্তি বা ভালো-মন্দ পার্থক্যকরণের ক্ষমতা দিয়েছেন, যা অন্য কোনো প্রাণীকেই দেওয়া হয়নি। এদিক থেকেও মানুষ শ্রেষ্ঠ।

পৃথিবীর সব প্রাণী পরাধীন। শুধু মানুষকেই স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। মানুষকে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি আল্লাহতায়ালার বিধান মানাও মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর বলো, সত্য তোমাদের রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে যেন ইমান আনে এবং যে ইচ্ছা করে সে যেন কুফরি করে।’ (সুরা কাহফ: ২৯)

বস্তুত মানুষ সর্বোচ্চ দায়িত্ববান হওয়ার কারণেই সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী। তাই এ মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য মানুষকে তার দায়িত্বে সচেতন হওয়া জরুরি। এজন্য আল্লাহ প্রদত্ত যাবতীয় বিধিবিধান বাস্তবায়নে যত্নবান হতে হবে।

মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে জন্মগতভাবে সব মানুষ সমান। তবে আল্লাহতায়ালার বিধিবিধান ও আদেশ-নিষেধ পালনে যে যত বেশি অগ্রগামী হবে, তার মর্যাদা আল্লাহর কাছে তত অধিক হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং পরে তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্য থেকে সেই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে সর্বাধিক মুত্তাকি।’ (সুরা হুজরাত: ১৩)

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION